হৃদয় পড়েছে বাঁধা নাড়ির বন্ধনে , প্রিয় কলকাতা!

একটা বিস্ময়সূচক উক্তি এবং মৃদু উত্তেজনাময় আলোড়ন নিয়ে সিপিএম জমানার গল্প জানতে আমি আগ্রহী হলে; টাকমাথার রাশভারী চেহারার প্রবীণ লোকটি কোনো উত্তর না দিয়ে চশমাটা ঠিক করে নিলেন। অতঃপর পাশে রাখা খবরের কাগজে মনোযোগী হয়ে ওঠলেন।পাত্তা না পাবার বাজে অভিজ্ঞতা থেকে বেরুতেই কিনা হ্যাংলার মতো জানতে চাইলাম-কলকাতা মানেই ‘মাছে ভাতে কলকাতা’ নাকি ‘দই-রসগোল্লার কলকাতা’? এবার মেঘভাঙা বৃষ্টির মতোই বাক্যহীন সংযম ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়ে আচমকা বিদ্রুপময় হাসির ঝলক দেখালেন! জানালেন উপমা দুটির একটিও তার নিকট জুতসই মনে হচ্ছে না। সুদীর্ঘ জীবনাচরণগত দৃষ্টিভঙ্গিতে তার নিকট কলকাতা মানে কিন্তু ধর্মতলার মোড়ে রেঁস্তোরা বা ‘কেবিন’-এ বসে গুরুত্বপূর্ণ আলাপ সারতে সারতে বাবুদের মতো পা দুলিয়ে দুলিয়ে অন্তত ডাবল হাফ চায়ের চুমুকে পরিতৃপ্ত হওয়া।

অতঃপর ভদ্রলোকের সাথে খাতির জমাতে ধর্মতলা মোড়েই যেতে হলো। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই, দীর্ঘশ্বাস চেপে মৃদুস্বরে শৈশবে শোনা গল্পগুলোরই যেন তর্জমা করলেন। বাপের দেশ ছিল মানিকগঞ্জ। বর্ষাকালে সেখানকার ঝিলের পানিতে বৃষ্টির তরঙ্গ। বৃষ্টির মিষ্টি পানির ছোঁয়া পেয়ে ফসল ফলতো মাঠে। তরতরিয়ে মাচান জুড়ে বেয়ে ওঠতো কচি লাউয়ের ডগা। ফাগুন হাওয়ায় আন্দোলিত হতো যুবতীদের রেশমিচুল। ছোটবেলার সেই স্কুল, মাটির ঘর, বাঁশের বেড়া… তারপর তো এই ইট-পাথরের জীবনে যুদ্ধ করতে করতে হাফিয়ে ওঠা। এবারে ভদ্রলোক বুকের অতল গভীর ছেনে, ভিতরের জমানো হতাশাটা বাতাসে ভাসিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখলেন। তারপর প্রচণ্ড খেদ নিয়ে বললেন; একই দেশ, একই রকম মানুষ, একই ভাষা, একই জাতিসত্তা, শুধু ধর্মের কারণে দেশটাকে ভেঙে মানুষগুলোকে আলাদা করে ফেলা হলো। দেশভাগ ষড়যন্ত্রে সাতপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে সম্ভ্রমহারা অগণ্য মানুষ হয়ে গেলেন উদ্বাস্তু!

এই দেশভাগের সীমানা নির্ধারণকারী ব্যক্তিটি স্যার সিরিল র‌্যাডক্লিপ। আমার মনে ভদ্রলোকের জন্য এখন একটু করুণাই হচ্ছে; আহা! কতো কতো মানুষের অভিশম্পাত যে তার জীবনে জুটেছে!
বৃটিশ আইনজীবী রেড ক্লিফ আর কখনো ভারতবর্ষে আসেন নি

আলাপে আলাপে রাশভারী লোকটি অধিকতর নিকটতম হয়ে ওঠলে; তখন আমি আর তার কাছে ব্রাত্যজন থাকি না। স্মৃতির ঝাপি মেলে ধরে জানান, তখন ৮৩ কি ৮৪ সাল। দ্বিতীয় বামফ্রন্ট জমানা। জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন গুলোর দাপটে সব কারখানায় শুরু হয়েছে লকআউট। তিনি শ্রমিক থেকে হয়ে ওঠলেন ট্রেনের হকার। নিজের অস্তিত্ব বাঁচাতে সে এক টাফ টাইম ছিল বটে; একেবারে দিশেহারা অবস্থা। তাদের মধ্যে যারা একটু-আধটু চটুল গান আউড়াতে পারতেন, তাদের অনেকেই ট্রেনে গান-বাজনা করে ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে দিন গুজরান করতে থাকলেন। শেষমেশ শ্রমিক থেকে ভিখিরিতে অধঃপতনের ইতিহাসে সংক্ষুব্ধ হয়ে তিনিও আরও অনেকের মতো প্রথমে কংগ্রেস, পরে মমতা ব্যানার্জির পাঁড় সমর্থক বনে গেলেন।

তিনি আজও মনে করেন, বামেদের ট্রেড ইউনিয়ন বাজিতে ১৯৭৭-৮৭ এর মধ্যে ৮০ ভাগ প্রোডাকশন ইউনিট বন্ধ হয়েছে, নইলে তালা ঝুলেছে। চুরুটে আগুন ধরিয়ে চারপাশটা আবার সন্দিগ্ধ চোখে আচম্বিতে পরখ করে নিলেন। অতঃপর বাজখাঁই গলায় বলে ওঠলেন,

-যতোই ব্যাটল অব স্তালিনগ্রাদ, বলশেভিক রেভ্যলুউশন, লং মার্চের গল্প শুনে শিহরিত হোন না কেন; কলকাতার বাম জমানা স্ক্রুটিনি করলে মশাই আপনাকে ভিন্ন সত্যের মুখোমুখি হতেই হবে!

-কিন্তু ওটা তো ছিল কেন্দ্রের অধীনে রাজ্য শাসন। কেন্দ্রকে উপেক্ষা করে কোনো বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার ছিল না সিপিএম বা জ্যোতিবসু বা বুদ্ধদেব কারোই। কেন্দ্র চাইলে রাজ্য সরকারকে বরখাস্ত করার অধিকার পর্যন্ত ছিল। আর দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে কিছু ক্ষেত্রে ভুল-ভ্রান্তি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অস্বাভাবিক নয়।
ডাবল হাফ চা

শেষমেশ নিজের নিজের অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন করে বিনয়ের সাথে প্রবীণ লোকটি স্বীকার করলেন, সিপিএমের অপারেশন বর্গা ও ভূমি সংস্কার কর্মসূচিতে নিম্নবর্গের মানুষ ব্যাপক উপকৃত হয়েছে। শুধু নিম্নবর্গের হিন্দুরাই নয়, মুসলমানেরাও উপকৃত হয়েছে।

ভদ্রলোকের সাথে করমর্দন শেষ করে পা হাঁটা দিতেই, ডলার রুপিতে কনভার্ট করতে সহসাই একটি মানি এক্সচেজ্ঞ দোকান চোখের সম্মুখে ভেসে ওঠে। প্রয়োজন মিটিয়ে বাইরে বেরুতেই দেখছি প্রায় যাত্রীপূর্ণ বাসটা ফুল স্পিডে গন্তব্যের পথ ধরেছে। তার পাশেই লাইনে দাঁড়িয়ে লোকজন গোগ্রাসে গিলছে স্ট্রিটফুড। কলকাতা স্ট্রিট ফুডের ‘বেতাজ বাদশা’ কথাটা আক্ষরিক অর্থে সত্য। চট-জলদি বানানো যায়, তাড়াতাড়ি খেয়েও ফেলা যায়। এটা যদি স্ট্রিট ফুডের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয় তবে ‘রোল’ এক্ষেত্রে প্রথম। বাংলাদেশে ‘শর্মা’বলে পরিচিত খাদ্যটির কিছুটা কাছাকাছি কলকাতার ‘রোল’। ফুচকা, আলুকাবাব, তেলেভাজাই শুধু নয় আলু টিক্কি, বেলপুরি, লিট্টি চোখা’র মতো সর্বভারতীয় খাবারের সন্ধানও রাস্তার পাশেই অনায়াসে পেয়ে যাবেন।

ছোটবেলা থেকেই শুনছি, প্রতিবেশি দেশ হলো ভারত আর পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের কলকাতা সেই দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী। ইউরোপের অন্যান্য অভিজাত শহরের মতো কলকাতা এবং ঢাকার মধ্যে নেই কোনো ভিসামুক্তির চুক্তি। তবে এটা মানতেই হবে যে ভাষা, জীবনধারা এবং ভূখণ্ডীয় আবেগ মিলিয়ে পদ্মা ও গঙ্গাপাড়ের লোকেরা এখন আগের যে কোনো সময়ের চাইতে কাছাকাছি।

জীবনে প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। যারপরনাই মাদকতায় প্রিয় গানের সুরে আবিষ্ঠ হয়ে আগেরদিন পৌঁছেছিলাম বেনাপোল বর্ডারে। আমার সাথে ভোর নাগাদ ওখানে বাংলাদেশের কাস্টমস-ইমিগ্রেশন সেরে নো ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে ভারতীয় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের জন্য অপেক্ষা করছিলেন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া পেশাজীবী, ব্যবসায়ী ও পর্যটকরা। আমার মতোই যারা প্রথমবার যাচ্ছিলেন; তাদের ভেতরেও কাজ করছিলো গমনজনিত শিহরণ-রোমাঞ্চ। কিন্তু নানা উদ্ভট প্রশ্নে জেরবার করে মধ্যবয়সী এক ভারতীয় ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা এসব বাংলাদেশিদের রোমাঞ্চ কি; সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ভ্রমণের ক্লান্তিটাই ভুলিয়ে দেন! অনুভূতির ভ্রম বা হ্যালোসিনেশন তৈরি হয়। মনে হলো; বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উদার না হওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের দুই-একজন অফিসারই যথেষ্ঠ। মনে পড়লো আই কে গুজরাল সাহেবকে, পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি যে ‘গুজরাল ডকট্রিন’ অনুসরণ করেছিলেন, তার মূল কথাই ছিল বৃহৎ দেশ ‘বড় ভাই’ হিসেবে ভারতকে বৃহৎ হৃদয়ের অধিকারী হতে হবে।
কলকাতার সেই বিখ্যাত ট্রাম রাস্তা

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নে ‘গুজরাল ডকট্রিন’ এখন যেন স্রেফ নীতিকথা। তিস্তার জলের মতোই অধরা। এপাড়ে যখন জলশূন্য জনগণের দীর্ঘশ্বাস এবং সেই দীর্ঘশ্বাসের মাঝে জিইয়ে রাখা ভারত বিরোধিতা নিয়ে নির্বাচন মৌসুমে চায়ের কাপে আমরা দেখি ঝড়। আর ক্ষুদ্র প্রতিবেশিকে বঞ্চিত করে সীমান্তের ওপারে তখন ভোটের মৌসুমে বিজেপির দাদাদের জাতীয়তাবাদী দাম্ভিকতার ‘ম্যায় ভি চৌকিদার’।

সব বাধা-বিপত্তি দূরে ঠেলে অবশেষে যখন পদযুগল স্পর্শ করেছিল বিশ্বকবি, জীবনানন্দ, শীর্ষেন্দু, সুনীল ও সমরেশের প্রিয় শহরে। গুনগুনিয়ে দুলে ওঠা চিত্তে হৃদমাঝারে তখন কে যে সুর তুলেছে- ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে/ তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ’। দেখেছিলাম আন্তরিক অভ্যর্থনার সাথে হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়ার আদর্শ উপকরণ ক্যাফেইন নিয়ে সেখানে কীরকম পথ আগলে ধরেছিলেন- হরিদাসপুরের মুদি দোকানিরা? চা খেয়ে পুনরায় কলকাতা অভিমুখী নয়া বাস ধরতে ধরতে ভাবছিলাম উত্তরে দার্জিলিঙের হিমালয়, দক্ষিণে সুন্দরবন, এ রকম বৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোন শহরে আছে? বাসের ভেতরে জানালা ছুঁয়ে দেখেছি, ছায়ামাখা অঘ্রাণের মিঠে রোদ্দুর ছড়ানো ধানি জমি। মেঠোপথে দুরন্ত গতিতে বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুল যাচ্ছেন কিশোরীরা। সবুজ মাঠে গরু চড়াতে শশব্যস্ত কিছু রাখাল। গাঁয়ের চা দোকান থেকে ভেসে আসা হিন্দি ছবির মাদকতা, সেই সুরে বুঁদ হয়ে পায়ের উপর অন্য পা তুলে নাচাচ্ছেন কেউ কেউ। পাতার বিড়ি, সিগারেট আর চায়ের ধোঁয়া মিলমিশে একাকার! দেখেছি, আরও দূরে শান বাঁধানো পুকুরে… স্নান শেষের লাবণ্য; জগতের সব পার্থিব পুণ্য নিয়ে গৃহে ফিরছেন পশ্চিমবঙ্গের রমণীকুল!

ওখানে পৌঁছার পর পার্ক স্ট্রিট, মির্জা গালিব স্ট্রিট, মারকুইস স্ট্রিট, নিউমার্কেট ঘুরে ঘুরে দেখি। পছন্দসই হোটেল খুঁজে পেতে গিয়ে পেয়ে গেলাম নয়নাভিরাম একটি গেস্টহাউজ। মুকুন্দপুর জায়গাটা মন্দ না। প্রতি রাত্রিবাসের খরচ সেখানে মাত্র পাঁচশ রুপি। এসময় মধ্যবয়সী এক লোক হাত নেড়ে ডাক দিলেন। কাছাকাছি যেতেই বললেন, ‘নমস্কার, দাদা কি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, নাকি?’ হ্যাঁ বলতে না বলতেই জিজ্ঞাসা, বাড়ি কোথায়? সিলেট। ও চমৎকার জায়গা, আমার পূর্বপুরুষের বাড়ি তো ওখানেই! ৪৭-এ দেশভাগের পর আমার বাবা এখানটায় চলে আসেন। আসলে বাংলাদেশের মানুষ কি যে ভালো!
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল

একটু পরেই তার মতলব টের পাই। যখন বলেন, ‘দাদা ডলার ভাঙাবেন নাকি? আপনি যে হোটেলে, সেটা তো খুবই খারাপ। আরো কমে ভালো হোটেল আপনাকে দিতে পারবো। দাদা, আর কিছু লাগলেও অনায়াসে বলতে পারেন। কারণ আমি আপনার দেশের লোক। কলেজ-ভার্সিটির সুন্দরী মেয়েছেলে আছে, লাগবে নাকি? একদম খাসা মাল!’

এবার লোকটিকে ভালোমতো পরখ করলাম; খোঁচা খোঁচা আধপাকা দাড়ি, গালের চোয়াল ভেঙে গেছে, পরনে সাদা ফতুয়া। এরকম দালালে যে গিজগিজ করছে গোটা কলকাতা, তা আগে থেকেই জানতাম। ‘ধন্যবাদ’ বলে তাই পায়ের গতি দ্রুতই বাড়িয়ে দিলাম।

কলকাতার ল্যান্ডমার্ক কোনটি এ নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। তবে বিদেশিরা হাওড়া ব্রিজের চাইতে সবসময়ই এগিয়ে রাখেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলকে। ১৯০১-এ রানির মৃত্যুর পর মূলত কার্জন সাহেবের উদ্যোগেই শুরু হয়েছিলো এ স্মৃতিসৌধ তৈরির কাজ। স্থাপত্যের মধ্যভাগের একটি ডোম বা গম্বুজ এটিকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। এই ডোমটির ঠিক নীচের ঘরটিকে বলা হয় ‘কুইন‘স হল’। চোখ বারেবারে সাঁতার কাটে, এই ডোমটির মধ্যস্থলে বসে থাকা বিউগল হাতে ডানা মেলা ব্রোঞ্জের সেই পরীটি দেখে!

নীচে, ভেতরে এই ঘরটির পাশ দিয়ে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে চলে যাওয়া যায় ওপরে। ডোমটির গোলাকৃতি ঘিরে রেলিং দেওয়া পথ বেশ সুন্দর। এর মাঝেই ছড়িয়ে রয়েছে ১২টি বেশ বড় মাপের ছবি। আঁকিয়ে একজন উন্নত রুচির শিল্পী। বিখ্যাত ব্রিটিশ প্রতিকৃতি আঁকিয়ে শিল্পী ফ্রাঙ্ক। ১৮৩৭ থেকে ১৯০১ পর্যন্ত রানি ভিক্টোরিয়ার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী এই চিত্রশৈলীতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তাজমহল এখনো দেখিনি, তবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে আমার কাছে ছবিতে দেখা তাজমহলের কাছাকাছিই মনে হলো।

পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে ফোনে কথা হয় আনন্দবাজার গ্রুপে কর্মরত কবি শ্যামল কান্তি দাশ এবং ঈশিতা ভাদুড়ীর সঙ্গে। এর মধ্যে ঈশিতা ভাদুড়ী এসে পরদিন কলেজ স্ট্রিটে দেখা করেন। উত্তর কলকাতায় বেড়ে ওঠা এবং ওখানটাতে পড়াশোনা করা ঈশিতা জানান, কলকাতা ঘুরতে হলে চোখে মেখে রাখতে হয় একটু কলকেতে আমেজ। হাঁটতে হবে শহরের হলুদ ল্যাম্পপোস্টের রাস্তায়। কলকাতাকে ভালোবাসতে হবে প্রাণখুলে আর ভালোবাসা অবশ্যই বিলিয়ে দিতে হবে হরেক রকম রঙে রাঙানো দেয়ালগুলোকে! তার কাছেই জানা হলো, কলকাতার নিজস্ব আরোও একটা বৈচিত্র্য আছে। সেটা হলো, এই শহরের মেয়েদের সাজগোজে। আগে থেকেই নাকি ২৯টি রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের সাজসজ্জার একটা নিজস্বতা ছিল। যাকে বলে কেতা। এখন সকলেই যেন একই স্রোতে গা ভাসিয়েছে। সকলেরই স্ট্রেট চুলে রং করা। মুখে হাল্কা মেক আপ। কাকে কী মানায়, সেটা না ভেবেই সকলে এখন হতে চায় আল্ট্রা-মডার্ন। ইদানীং পুজার সময়েও অনেকের পরনে থাকে টপস এবং জিন্স!
কলকাতা নিউ মার্কেট

সেই দুপুরে খাসির মাংস দিয়ে ভরপুর খাইয়ে তিনি আমাকে নিয়ে ছুটলেন মান্না দে ক্যাফেতে; যখন জানলেন হৃদয়ের গোপন কুঠুরিতে তার জন্য জমা আছে অনেক ভালোবাসা! শহরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা হাল জমানার কফি কর্নারের কাছে বেশ কোনঠাসা মান্না দে’র কফি হাউস। তবু মনে হলো এক কাপ কফি, কিছু স্ন্যাক্স, হালকা গান আর বই মিলিয়ে লিজেন্ডকে স্মরণ; মন্দ হয় না!

তখন শেষ বিকেল, আলোয় দিনান্তের রূপ। কফির উষ্ণতায় আর বাংলাদেশিদের প্রতি শ্রদ্ধামাখা মুগ্ধতার গল্পে মজে, কখন যে চলে এসেছি হাওড়া ব্রিজে টের পাইনি। হুগলি নদীর তীরে দুই যমজ শহর কলকাতা আর হাওড়ার এটি সংযোগ রক্ষাকারী ব্রিজ। এটির অভিনবত্ব হলো, একটিও নাট-বল্টু লাগাতে হয়নি। আবার ব্রিজটির দিকে ভালো করে তাকালে দেখবেন, কোন পিলার বা স্তম্ভ ছাড়াই ব্রিজটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আদি পন্টুন ব্রিজ বা ভাসমান সেতুটিই পরবর্তী সময়ে নতুন নির্মাণে হাওড়া ব্রিজ। যার পোশাকি নাম ‘রবীন্দ্র সেতু’।

শহরে গরম অত্যাধিক। দূষণের সাথে ক্ষয় বেড়েছে। চোখ বুলিয়ে দেখলাম ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গা আগের চাইতে ক্ষীণ হয়েছে; তার সঙ্গে দর্শনধারীদের শরীরের উপর মৃদু বাতাসে মশার ঝাঁক উড়ে বেড়াচ্ছে, কখনো কামড় বসাচ্ছে মুখের উপর, কখনো নেচে বেড়াচ্ছে জলের উপর দলবদ্ধভাবে। তবু নতুন ব্রিজটির বয়স ছিয়াত্তর হলেও শরীরে জরা থাবা বসায়নি। স্বাস্থ্য টাল খায়নি একটুও! মোহময়ী সন্ধ্যার সোডিয়াম আলোয় হাওড়া স্টেশনে এসে ট্রেন ফেল করা মানুষের মতোই আমিও অনেকটা অবাক বিস্ময়ে দেখছি লোহার নকশার জাল! শিল্পের কী অসাধারণ বুনট!

উল্টোদিকের রাস্তার পাশেই একটি গাছের বিস্তীর্ণ শাখা-প্রশাখার ভেতরেই ঝলমল করে ওঠলো চাঁদ। সে আলোয় কেমন যেন রুপোর মতোন ঝিকমিক করে ওঠলো পাতাগুলো। ফিরছি মুকুন্দপুরের ঢেরায়। এই মুহূর্তে বাসে তারা মাত্র জনাকয়েক যাত্রী। বাকিরা একে একে নেমে গিয়েছে নিজেদর গন্তব্যে। কন্ডাক্টর সারাদিনের ডিউটি সেরে এখন ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে ঝিমোতে ব্যস্ত। সে অলস দৃষ্টিতে দেখে নিল চতুর্দিকটা। একদিকে এক বৃদ্ধ হাঁড়িমুখ করে বসে আছেন। আবার পাশাপাশি চারজন নারী-পুরুষ য়ৌথভাবে আসনে। কোনো নারী সিট ফাঁকা দেখেও অন্য আসনে যাচ্ছেন না। কোথাও নেই পুরুষালি অভব্যতা। তাঁর ঠিক দুটো সিট পরেই এক সুন্দরী যুবতীর পাশে আমি। পরিচয়ে জানা হল নাম মিত্রা দেবী। সাকিন নিউ আলিপুরের। ‘ইটসি বিটসি’ নামে জনপ্রিয় খাবার প্রতিষ্ঠানে খাবার সাপ্লাই করেন। বলেন, আমি প্রায় ৫ বছর ধরে হোম মেড খাবার তৈরি করে গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করছি। তবে সম্প্রতি আমি আমার স্কুলের জব ছেড়ে দিয়ে পুরোটা সময়ই পরিবারকে এবং আমার এ কাজে দিচ্ছি। প্রতিমাসে প্রায় ১৪০০ জনের খাবারের অর্ডার সরবরাহ করি আমি। ভারতীয় রীতিতে নমস্কার জানিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলেন তিনি। যাবার আগে প্রাণবন্ত হাসিতে যেন রেখে গেলেন নারীবাদের জয়োল্লাস!
হাওড়া ব্রিজ

সতেরশো রুপি দিয়ে হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনের টিকিট কাটি। এবারের গন্তব্য রাজধানী দিল্লী। যেখানকার লাড্ডু খুবই বিখ্যাত! খেলে পস্তাতে হয় আবার না খেলেও! তবু পর্যটকের চোখে এঁকে রেখেছি কলকাতার প্রতিটি মুহূর্ত যেমন এর বনেদীয়ানার স্বাক্ষর বহন করা পুরনো অভিজাত দালান, আর তার মাঝখানের সরুগলির পুরনো কলকাতা। আর অন্যদিকে চকচকে আধুনিক স্থাপত্যের সল্টলেকের নিউ কলকাতা।

অন্যপৃষ্ঠায় থাকা ঘোড়ার গাড়ি, জীর্ণ ঘুপচি দালাল-বাড়ি। মধ্যবিত্তের পরিশ্রান্ত মুখাবয়ব। লোকাল বাস আর মেট্রোয় গাদাগাদি করে ঝুলে ঝুলে নারী-পুরুষের কর্মস্থলে যাওয়া-আসা। রাস্তাজুড়ে হকারদের চিৎকার, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল নিয়ে পুরো জাতির দুই ভাগ হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত ক্রিকেটপ্রীতি, এই ম্যাটার অব সাবজেক্টে ঢুকে পড়লে- কলকাতা আর ঢাকা তখন আলাদা থাকে না। যেন অবিচ্ছিন্ন সংযোগ শহর। বাঙালির অস্তিত্ব থেকে একে পৃথক করে মুছে ফেলা যায় না বলেই কিনা মনের গোপন মেমোরি কার্ডে আজও সাজিয়ে রেখেছি প্রিয় কলকাতার জন্য কয়েকছত্র:

পথের পাথর থেকে জলস্রোত ঝরে না কখনো/আমাকে ডাকে তোমার জনস্রোতে লেপ্টে থাকা সেই চেনা দৃশ্য/ সল্টলেক, কলেজস্ট্রিট, র্ধমতলার মোড়…/ দুঃখের মহড়া পায়ে কলকাতা ছুটে ঘরছাড়া স্রোতের মানুষ!/ দু’পা এগিয়ে এক পা পিছিয়ে জ্ঞান ও বোধের সড়কে আমিও তোমাকে ছুঁই/ শুনি ভোরের স্বপ্ন ভেঙেচুরে র্প্রাথনায় বসা দু’পারের মানুষের মৌনবাণী/ ভাষার পবিত্র শক্তি একদিন বদলে দেবে সীমান্তের জ্যামিতি!

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*