শৈশবে আমি বেশ মোটাসোটা ছিলাম আর সেকারণেই হয়তোবা খুব দ্রুত আমার স্তনের আকার বেড়েছিল। প্রথমে আমার ফ্রকের সামনে কুচি কুচি দেয়া কাপড় জুড়ে দেয়া হলো, তারপর আমাকে ব্রা পরতে হল। তখনকার সময়ে এই পোশাকটি পরতে বেশ
বিরক্তিকরই লাগতো। তবে ব্রা পরতে চাওয়া বা না চাওয়ার চেয়ে বড় চিন্তার বিষয় ছিল এই শংকা যে ‘স্তনের আকার নষ্ট হয়ে যাবে’। মা খালা, চাচী, মামীরা কানের কাছে ফিসফিসিয়ে জানিয়ে যেত এ কথা। কিন্তু কোন আকার? ছোট্ট মনে প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে আতংক বাড়তো।
স্তনের আকারের উপর ভালো বর জোটে। স্তনের আকার পরিবর্তনে নষ্ট মেয়ের খেতাব জোটে! আমাদের সমাজে এই ধরনের কথাও এখনো প্রচলিত। ছোট বেলায় খেলতে যেতে আমার এক সহপাঠির বুকে এক ছেলের হাত লেগেছিল অথবা ছেলেটি মেয়েটির স্তন চেপে ধরেছিল, মেয়েটি আতংকিত হয়ে ঘটনাটা আমার সাথে শেয়ার করে বলেছিল, ‘এখন কি আমার দুধ বড় হয়ে হয়ে যাবে? লোকজন ভাববে আমি খারাপ কাজ করি?’
রাস্তাঘাট হাটবাজারে ভিড়ের ভেতর অজস্র পুরুষের হাত অক্টোপাস হয়ে জড়িয়ে ধরে, লাঞ্ছিত করে হাজার হাজার শিশু, কিশোরী, তরুণী এমনকি মধ্যবয়সী নারীর স্তন।
‘মেয়েটার বুক পিঠ সমান’, ‘কিসসু নাই’ অথবা ‘ওরে বড় দুধ’। রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে স্তন ছোট ও বড় মেয়েদের এমন কথা অহরহই শুনতে হয়। যে দেশের পুরুষরা নারীদের সুন্দর আর পাতলা দেখতে চায় সেখানে বক্ষহীন নারীকে কটু কথা শোনায়, ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত!
আমার স্তন ছোট না বড়, টানটান না ঝোলা সেটা তো একান্তই আমার ব্যাপার হওয়ার কথা, তাই না? এটা তো আমার শরীরেরই অংগ, আমার স্তনের আকার কিংবা আদৌ এর অস্তিত্ব থাকবে কিনা, সেই বিধান ঠিক করে দেবার অধিকার অন্যকে কে দিয়েছে?
পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতিকে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে শ্রীমুয়ি পিউ কুন্ডু লিখেছেন, ‘আদতে আমাদের স্তন কখনোই আমাদের নিজেদের নয়। বাস্তবিক অর্থে এটি হল পবিত্রতা, পাপ কিংবা লজ্জ্বার উৎস। আমার স্তন প্রসঙ্গে সবসময় মায়ের অনুমোদন প্রয়োজন হয়, বাবা কিংবা ভাইদের সামনে যাওয়ার সময় আমাকে ব্রা পরতে হয়। জনবহুল এলাকায় কিংবা বাসে চলাফেরার সময় পুরুষের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে স্তনগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। আমার সব প্রেমীরাও আমার স্তনের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। আমি কল্পনা করি, আমার যখন বাচ্চা হবে, তাকে কোলে নিয়ে স্তন্যদান করব, তখন তা দাগে দাগে ভরে যাবে। কিন্তু আমার কিচ্ছু মনে হবে না। নারীদের স্তন কী কেবলই পুরুষদের প্রয়োজনীয়তা এবং আকাঙ্ক্ষা মেটানোর জন্য?’
বিতর্ক চলতে থাকে, স্তনের উপর কার অধিকার বেশি, স্বামী না সন্তানের? কী অদ্ভুত! স্তন আমার সেখানে আমার অধিকার নেই এবং স্তন নিয়ে নিয়ে আমার চিন্তা না থাকলেও জগতজোড়া মানুষের চিন্তার শেষ নেই!
স্তন ছোট-বড়, টানটান-ঝোলা-এই পার্থক্যগুলো, এই বৈশিষ্ট্যগুলো সব নারীর মাঝেই বিদ্যমান, দুর্লভ কিছু নয়। অথচ এই নিয়েই সে কী উত্তেজনা; জগৎজোড়া এই ভেবেই হয় লখো-কোটি ডলারের পর্নো বাণিজ্য, বাজারে বিকোয় কত বাহারি বক্ষবন্ধনী। এর জোরেই কারো ‘ভালো’ বর জোটে, কারো বিয়ে হয় না।
পৃথিবীতে ছয়শ কোটি মানুষের মধ্যে অর্ধেক নারী। তিনশ কোটি নারীর ছয়শ কোটি স্তন। বিষয়টা আমাদের সবার জন্যই তাই খুব স্বাভাবিক হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কারণ, দুর্লভ জিনিসের প্রতিই নাকি মানুষের টান, আর সে হিসাবে নারীর স্তন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, কিন্তু দুর্লভ নয়। অথচ স্তন শব্দটা আজও যেন রহস্যময়। ভয়, লজ্জা, উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা তৈরি হয় এই শব্দটাতেই। পুরুষত্বের জন্য তো বটেই, নারীর জন্যও এ এক অন্য জগৎ।
একবিংশ শতকের আধুনিকতার সময়ে স্তন নিয়ে আমাদের এই মাতামাতি যেন প্রমাণ করে দেয়, পুঁজিবাদের এই স্বর্ণযুগে নারীর স্তন নিয়ে এই উত্তেজনা বাণিজ্য বিকৃতি ছাড়া কিছু নয়। এই উত্তেজনা রোমান্টিকতা নয়, কদর্য বাণিজ্য